খবরের বিস্তারিত...

জঙ্গী

‘জঙ্গি মতাদর্শ ভিত্তিক ঐক্যঃ প্রসঙ্গ- উচ্চবিত্তমহলে জঙ্গি নেটওয়ার্ক’ – শাহীদ রিজভী

‘জঙ্গি মতাদর্শ ভিত্তিক ঐক্যঃ প্রসঙ্গ- উচ্চবিত্তমহলে জঙ্গি নেটওয়ার্ক’
(প্রথম পর্ব)
_ এডভোকেট মুহাম্মদ শাহীদ রিজভী (অর্থ সম্পাদক, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ)

BRAC University তে পড়াকালীন দেখেছি একটা বিশেষ শ্রেণী গোষ্ঠীর সন্তানদের টার্গেট করে আহলে হাদীস ও লা মাজহাবী বানানো হচ্ছে। তদুপরি ওদের ব্রেইন ওয়াশ করে ওদেরকে চরমপন্থী করে গড়ে তোলা হয়।

একসময় হিজবুত তাহরীর ওপেনলি কাজ করতো। নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে তারা আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে কাজ চালাচ্ছে বলে আন্দাজ করা যায়।

এরা উচ্চ শিক্ষিত, ধনী, মেধাবি ছাত্রদের টার্গেট করে। গুলশানেও তাই দেখা গেলো। এদের আখড়া ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। Specially নর্থ সাউথ, ব্র্যাক, ইস্ট ওয়েস্ট, এআইইউবি, ইন্ডিপেন্ডেন্টেন্ট, আহসানুল্লাহ এগুলোর শিক্ষার্থীদের এরা টার্গেট করে। গুলশান হামলার ঘটনাতেও তাই দেখা গেলো। আপাতত যা দেখা যাচ্ছে হিযবুত তাহরির আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নাম দিয়ে এবং হয়তোবা আইএস এর সাথে লিংকআপ করে ঘটনাগুলা ঘটাচ্ছে।

শিবিরের কিছু ছেলেও তাদের সাথে ভিড়ছে বলে ধারণা করা যায়। কিন্তু শিবির আর হিযবুতের মধ্যে হালকা কিছু আদর্শিক অমিল থাকার কারনে হয়তো তারা পুরোপুরিভাবে একাত্ম হয়নি এখনো। উল্লেখ্য হিযবুত গনতন্ত্র কে হারাম বলে, এবং জামাত কে এই পরামর্শ দেয় এই হারাম সিষ্টেম থেকে বের হওয়ার জন্য, আর খুব সম্ভবত শিবিরের ছেলেরা এদেরকে খারেজি বলে। এদিকে আবার অনেক শিবিরের ছেলে হিযবুত তাহরিরে যোগ দেয় হিযবুত কে বেটার মনে করে। একারণে কিন্তু জামাতের অনেক নেতা আপাতদৃষ্টিতে হিযবুতের উপর ক্ষ্যাপা। কিন্তু আমাদের পর্যবেক্ষণ বলে ‘হিযবুত আর শিবির’- “রসুনের কোয়ার গোড়া কিন্তু একটাই।” কারণ আপনারা লক্ষ্য করবেন হিযবুত এর উত্থান কখন? যখন দেশব্যাপী ‘জামাতীরা রাজাকার’ আর ‘শিবির রগকাটা’ হিসেবে জনগণের কাছে ধিকৃত হচ্ছিল। যখন তারা দেখলো জনগণকে এই ‘শিবির শরাব’ গেলানো যাচ্ছে না, ঠিক তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর এক শিক্ষকের তত্বাবধানে হিযবুত তাহরীর এর উন্মেষ ঘটানো হয়। আরও লক্ষ্য করলে দেখবেন, জামাত শিবিরের আদর্শিক আইকন মওদুদী, আর হিযবুত এর আইকন হলো মওদুদীর প্রিয়তম হাসানুল বান্না।

সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হলো- এই হিযবুত তাহরিরের সদস্যদের বেশীর ভাগের পরিবার খুবই প্রভাবশালী। কেউই নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসেনি। এদের পিতা মাতা অনেকেই সচিব পর্যায়ের, সেনা কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্তা, চিকিত্সক, প্রকৌশলী, শিল্পপতি, বড় ব্যবসায়ী, পুলিশ কর্মকর্তা, এমনকি বিএনপি এবং আওয়ামীলীগ এর বড় নেতা কর্মী। অর্থাৎ যারা রাষ্ট্রযন্ত্র ও সমাজের নিয়ন্ত্রক সেসব পরিবারের সন্তানদের এরা ব্রেইন ওয়াশ করছে। একটু চোখ কান খাড়া করলেই বুঝতে পারবেন আপনার আমার আশেপাশেই এরা লুকিয়ে আছে!!!

গভীরে ঢুকলে দেখা যায় জামাত শিবির, হিজবুত তাহরীর, জেএমবি, আনসারুল্লাহ, হালের আই.এস এরা সবাই কিন্তু একটা মতবাদের অনুসারী। আর এদের ব্রেইন ওয়াশ এমন ভাবে করা হয় যে, একটা সময় তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, যাঁরা তাদের মতবাদের বিরোধী তারা “মুনাফিক” “কাফির” “মুরতাদ”। আর এই বিরোধী পক্ষকে ক্বতল করা ওয়াজিব। এই ক্বতল এর কারণে “ক্বাতিল মুজাহিদ” এর জান্নাত নিশ্চিত। হ্যাঁ, এদের মতবাদের নাম সালাফীবাদ আর এর অনুসারীরা নিজেদের “আহলে হাদীস” বলে দাবি করে।

একটা বিষয় গভীর ভাবনার উদ্রেক করে যে, এই পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে যত জঙ্গি ধরা পড়েছে ওরা এক শত ভাগ সালাফী তথাকথিত আহলে হাদীস মতবাদে বিশ্বাসী। যারা মনে করেন বিগত চৌদ্দশত বছর ধরে চলে আসা ইসলামের পূর্বসূরী আলেমরা ভুল মতবাদ অনুসরণ করেছেন। আবহমান কাল ধরে আধ্যাত্মিকতার চর্চা করে আসা সুফি সাধকরা ইসলাম ও তার অনুসারীদের ভুল পথে পরিচালিত করে এসেছেন। এই সালাফী মতবাদীরা তাদের ভাবগুরু অধুনাকালের নাসিরুদ্দিন আলবানী ও পূর্ব মধ্য যুগের ইবনে তাইমিয়্যাহ ব্যতীত অন্য কোন লেখক বা মনীষীর দর্শনকে কোনও ভাবেই মানতে চান না। এমনকী তারা দ্বীন ইসলামের মহান আধ্যাত্মিক সাধক পুরুষ বড়পীর খ্যাত হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রঃ)কে ইসলামে আধ্যাত্মিক সাধনার নামে ‘নূতন আবিষ্কার’ অনুপ্রবেশ করানোর দায় চাপান। প্রসঙ্গক্রমে আধ্যাত্মিক সাধনার ইতিহাস ইসলামে কখনওই ‘নতুন আবিষ্কার’ নয়। বরঞ্চ হযরত মুহাম্মদুর রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা শৈশব কাল থেকেই আধ্যাত্মিক ধ্যান সাধনায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। এদিকে পাক ভারতীয় উপমহাদেশে যাঁর অক্লান্ত ত্যাগ ও পরিশ্রমের বদৌলতে দ্বীন ইসলাম মহীরুহ রুপ আকার ধারণ করেছে সেই খাজা গরীব নাওয়াজ খ্যাত হযরত মঈনউদ্দীন হাসান চিশতী সনজরী আজমিরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে সালাফীরা উপমহাদেশে শিরক বিদআত বিস্তারের মূল প্রতিভূ বলে অঙুলি নির্দেশ করে। অথচ এই খাজা গরীব নাওয়াজ এর উপমহাদেশে আগমনের সময় মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ট থাকলেও তাঁর ইন্তিকালের পর নব্বই লক্ষ মুসলমান তাঁর জানাজায় শরীক হন। এতেই বুঝা যায় ইসলাম প্রচারে খাজা গরীব নাওয়াজ কী ত্যাগ তিতিক্ষাই না দিয়ে গেছেন!

সালাফী মতবাদীরা এমনকী ইসলামের ইতিহাসের মহান দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-কে পর্যন্ত অবমাননা করে বক্তব্য রাখেন। অথচ ইমাম গাজ্জালীর দর্শন অদ্যাবধি প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য পর্যন্ত জ্ঞানী সুধী মহলের চিন্তার জগতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। শুধু কি তাই? দ্বীন ইসলামের প্রচার প্রসার ও মুসলমান জাতির জ্ঞান চর্চা ও উৎকর্ষ সাধনে বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখা “চার মাজহাব” এর “মহান ইমাম চতুষ্টয়” খ্যাত ইমাম আবু হানিফা নু’মান ইবনে সাবিত, ইমাম শাফিঈ, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এবং ইমাম মালিক আলাইহির রাহমা যাদের কাছে সমগ্র মুসলমান জাতি হাশরের ময়দান তক কৃতজ্ঞ থাকতে হবে সেই “ইমাম চতুষ্টয়”-কে পর্যন্ত দ্বীনের বিকৃতি সাধনের দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে কসুর করে না। উপরন্তু এই চার ইমামের অনুসরণ করা বা তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করাকে সালাফীরা “গোমরাহী ও মূর্খতা” বলে আখ্যা দেয়।

ইসলামের সোনালী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মানবিক মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠাতা ইসলাম। আর ইসলাম মানবতার প্রতি মমতা, ভালবাসাকে প্রাধান্য দিয়ে মুসলমান জাতিকে যে উচ্চকিত মর্যাদায় উন্নীত করেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

আল্লাহতাআলা কর্তৃক ঘোষিত ‘পূর্ণ জীবন বিধান’ দ্বীন ইসলাম কাল থেকে কালান্তরে প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছে ইসলামের কালজয়ী ভালবাসা ও সহমর্মিতার রুপের ধারক ও বাহক সুফিবাদের কল্যাণে। আজকের জঙ্গিদের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তাদের মধ্যে একজনও সুফিবাদে বিশ্বাসী নয়। সুফিবাদী ঘরানার ভালবাসা মমতার বিপরীতে উগ্রপন্থা ও যুদ্ধংদেহী মনোভাবকে তারা ইসলামের প্রকৃত রুপ বলে মনে করে। সুফিবাদকে তারা পছন্দ করেই না, বরং ওরা সুফিবাদে বিশ্বাসী সহজ সরল মুসলমানদের হত্যা করাকে জিহাদের অংশ বলে বিশ্বাস করে।

:::::::::চলবে ইনশা আল্লাহ:::::::::

 

[related_post themes="flat" id="390"]